ভালোবাসার প্রলেপ
– শিলাবৃষ্টি
হাতটা কি ভীষণ নিশপিশ করছিল… কিন্ত অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিল আয়েসা।
এই ছেলেটা তাকে ডে ওয়ান থেকে বিরক্ত করেই যাচ্ছে! যেখানেই দেখে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বলে চলে যায় “আই লাভ ইউ” অসহ্য লাগে।
নতুন জায়গা। খাপ খাওয়াতে কিছুদিন লাগবে। তবে এই অতিরিক্ত ঝামেলাগুলো কাটাতে সে ভালোভাবেই জানে। এই মহেশপুরেই সে বঙ্গ বালিকা বিদ্যালয়ের বায়োলজির টিচার হয়ে জয়েন করেছে গত মাসে। চাকরিটার তার খুব দরকার ছিল। বাবার এক পরিচিতের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে আছে। প্রতি শনিবার স্কুল করে বাড়ি যায়, ফেরে সোমবার সকালে। এখানকার পরিবেশ বেশ ভালোই। এখনো পর্যন্ত স্কুলেও কোনো অসুবিধে হয়নি! ইলেভেন টুয়েলভের মেয়েরা তার মতো নতুন টিচারকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছে।
শুধু এই এক আপদ রাস্তায় মাঝে মাঝেই বিরক্ত করে চলেছে। বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে আজ হঠাৎ বাইকটা সামনে এনে পথ আটকালো। ওর আবদার ওর সাথে বন্ধুত্ব করতে হবে। কী আশ্চর্য! পাশ কাটিয়ে যেই চলে আসার চেষ্টা করে আয়েসা হঠাৎ করেই ওর হাতটা ধরে ফেলে লোফারটা। ঝাঁকুনি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নেয় আয়েসা। কঠিন দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে ওর চোখের দিকে। “আই লাভ ইউ ম্যাডাম” কী সাহস ছেলেটার! মনে হচ্ছিল গালে একটা চড় মারতে! অনেক কষ্টে রাগটা সংবরণ করে।
খুব দ্রুত বাসার দিকে হাঁটতে থাকে। পেছনে তাকিয়ে দেখার সাহস হচ্ছে না।
একদিন সন্ধেবেলায় ছাদে পায়চারি করছিল আয়েসা, সাথে কাকুর মেয়ে নেহাও ছিল। আয়েসার চোখ গেল গেটের বাইরে। সেই ছেলেটা বাইকে হেলান দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। নেহা এসে পাশে কখন দাঁড়িয়েছে আয়েসা খেয়ালও করেনি। “আয়েসাদি দেখো দেখো ওই ছেলেটাকে। ওই যে বাইকে…ও না পাগল হয়ে গেছে! গত বছর ওর বাবা-মা দুজনেই এক অভিশপ্ত ভাইরাসে মারা গেছে মাত্র তিনমাসের ব্যবধানে। বাবা-মা অন্ত্য প্রাণ ছিল ওর।মায়ের মুখাগ্নি করে শ্মশান থেকে ফেরার পর কেমন পাগলামি করতে থাকে। আর ও যে মেয়েটাকে ভালোবাসতো সেও সরে গেছে! শুনেছি কোনদিন খায়, আবার কোনোদিন খায় না।”
আয়েসা অবাক হয়ে যায় সব শুনে। বলে “ওর বাড়িতে আর কেউ নেই?”
“কাকারা আছে। ওরা খুব একটা সুবিধের নয়।”
“ও…” আয়েসার কপালে ভাঁজ পড়ে।
“জানো আয়েসাদি, ও খুব ভালো স্টুডেন্ট ছিল। জয়েণ্টে খুব ভালো রাঙ্ক করেছিল।”
“ও কি চাকরি করতো?”
“না না এম টেক করছিল। লাস্ট ইয়ার। তবে বোধহয় পড়া ছেড়ে দিয়েছে” নেহা উত্তর দেয়। আয়েসা আবার তাকায় রাস্তার দিকে। দেখতে পায় না ছেলেটাকে।
“ওর নাম কি নেহা?”
” ময়ূখ… ময়ূখ মুখার্জি… “
চমকে ওঠে আয়েসা। এ নামটা তো একদিন তার ধ্যান জ্ঞান ছিল! সে মুসলিম বলে সম্পর্কটা টেকেনি।
মাস খানেক কেটে গেছে এরপর। রাস্তায় কেউ আর বিরক্ত করে না আয়েসাকে। তবু কেন দুটো চোখ কাউকে খুঁজে বেড়ায় বোঝে না আয়েসা।
পুজোর ছুটি কাটিয়ে আয়েসা ফেরে মহেশপুরে। আবার সেই রুটিন মাফিক জীবনের স্রোতে ভেসে চলা! স্কুল থেকে ফিরে কাকিমার ডাকে খাওয়ার টেবিলে গিয়ে বসলো আয়েসা।
“মা আমিও একটু চা খাবো।” বলেই নেহা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, “জানো মা, আজ নাকি ময়ূখদাকে কলকাতার মেন্টাল হসপিটালে পাঠিয়ে দিচ্ছে ওর কাকারা! বুবুন বলছিল ফোনে।”
” কি!” আয়েসা চমকে যায় কথাটা শুনে।
“হ্যাঁ গো আয়েসাদি। ও নাকি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে! এখন আর বাইরে বেরোয় না।
বাড়িতে একটা ঘরের মধ্যেই বসে থাকে!” কাকিমাদের দয়ায় যেটুকু জোটে তাও আর খায় না।” নেহার কথা না শেষ হতেই আণ্টি বলে ওঠে –
“খুব ভালো ছেলে ছিল! শুনলেও কষ্ট লাগে। আসলে ও সব হারিয়ে ফেলেছে। ভালোবাসা দেওয়ার কেউই নেই! “
আয়েসার গলা দিয়ে খাওয়ার নামছে না আর। কানের পর্দায় এসে আঘাত করছে দুটো কথা – আই লাভ ইউ। আমাকে একটু ভালোবাসা দেবে ম্যাডাম?….
না আর দেরি করা যাবে না। উঠে দাঁড়ায় আয়েসা। “নেহা আমাকে একটু নিয়ে যাবে ওদের বাড়িতে?”
আণ্টি বলে ওঠে “সেকি! কিছুই তো খেলে না মা… “
“আণ্টি আমি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি…”
বাড়ির বাইরে একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাড়ার লোকেরা বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চাপা আলোচনায় মত্ত।
মেন্টাল হসপিটালের ড্রেসপরা চারজন লোক প্রায় টানতে টানতে ময়ূখকে গেটের বাইরে আনছে। ময়ূখ কিছুতেই বাড়ির বাইরে আসতে চাইছে না। চিৎকার করছে
” মা মাগো….. আমি যাবোনা মা। বাবা…. বা বা গো… “
জোর করে ওরা টেনে আনার চেষ্টা করছে কিন্তু ময়ূখ গ্রিলটা সবলে হাতের মুঠোয় আটকে রেখেছে। পায়ে পায়ে আয়েসা এগিয়ে যায়।
“থামুন আপনারা। ও কোথাও যাবে না “
সবাই অবাক হয়ে আয়েসার দিকে তাকায়।ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বলে – “মানে? তুমি কে ওকে আটকানোর?”
“আমি এখানকার গার্লস স্কুলের টিচার! আর তার থেকেও বড় পরিচয় আমি ময়ূখকে ভালোবাসি। আর মোয়ূখও আমায় ভালোবাসে। তাই না ময়ূখ? একবার বলো সবার সামনে…”
ময়ূখ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আয়েসার দিকে। আয়েসা ময়ূখের গালে হাত রাখে। ময়ূখের দুচোখে জলের বন্যা। ও কাঁদছে। ভীষণ কাঁদছে। আয়েসা চারজন স্টাফকে বলে “আপনারা ফিরে যান প্লিজ, মেন্টাল ট্রিটমেন্ট-এর ব্যবস্থা আমি-ই করবো। আজ থেকে ময়ূখের সমস্ত দায়িত্ব আমার।”
অসাধারণ লাগলো ভালোবাসার প্রলেপ।
অসংখ্য ধন্যবাদ।